ভেলোরে চিকিৎসার খুটিনাটি সব কিছু
ভারতে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে যাত্রাঃ পর্ব ০১ ( ভিসা প্রাপ্তি ও কোলকাতা গমন)
কোন ভিসা করবেন: ভারতে যাবার জন্যে প্রথম পূর্বশর্ত হল ভিসা। আপনার যদি সাধারণ সাস্থ পরীক্ষার জন্যে ভারতে যাবার ইচ্ছা থাকে সা ক্ষেত্রে আপনি চাইলে ভ্রমন ভিসা (Tourist visa ) নিয়ে ভারতে যেতে পারেন। তবে নিয়ম হল ভারতে চিকিৎসার জন্যে যেতে হলে আপনাকে চিকিৎসা ভিসা (Medical visa) নিয়েই যেতে হবে। সুতরাং নিয়ম মেনে যাওয়াই ভাল কারন যদি আপনার জটিল কোনও রোগ ধরা পরে বা হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় সেক্ষেত্রে চিকিৎসা ভিসা না নিয়ে গেলে আপনাকে ফেরত পাঠানো হতে পারে।
মেডিকেল ভিসার জন্য যা যা প্রয়োজন :
১।অনলাইনে পরণকৃত ভিসা ফর্ম
২। ২ইঞ্চি * ২ ইঞ্চি সাদা ব্যাকগ্রাউন্ডের ছবি
৩। বিদ্যুৎ বিল/ গ্যাস বিল/টেলিফোন বিল এর কপি
৪। ডলার এন্ডরস্মেন্ট/ ব্যাংক স্ট্যাটমেন্ট/ ক্রেডিট কার্ড
৫। পাসপোর্ট এবং আগের ভিসা (যদি থাকে) এর ফটোকপি
৬। বাংলাদেশের ডাঃ এর সকল প্রেসক্রিপশন ও মেডিকেল রিপোর্ট এর ফটোকপি এবং অরিজিনাল কপি
৭। বাংলাদেশী ডাঃ এর রেফার লেটার
৮। ইন্ডিয়ান ডাঃ বা হাস্পাতালের এপয়েন্টমেন্ট লেটার
৯। চাকরীজিবী হলে বা ব্যাবসায়ি হলে ট্রেড লাইসেন্সের ফটোকপি, ছাত্র হলে আইডি কার্ড।
১০। এনআইডি বা জন্ম নিবন্ধন এর ফটোকপি।
যা যা মনে রাখা দরকার :
১. নকল ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্ট দেবেন না, ওরা যাচাই এর সময় জাল পেলে ভিসা তো পাবেন ই না হয়রানি হবে শুধু শুধু।
২. আবেদনকারীই অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকুরে হলে অবশ্যই অবসর এর কাগজ জমা দিন। সামরিক/আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য হলে অতিরিক্ত আরেকটি ফর্ম পুরন করে জমা দিবেন।
৩. ভিসা আবেদনের সময় আপনি কোন সীমান্ত বন্দর দিয়ে ভারত প্রবেশ করতে ইচ্ছুক তা লিখতে হয়। বেনাপোল, দর্শনা দিয়ে সড়ক ও রেলপথে এবং বিমানপথে যে কেউ ভ্রমন করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে আপনার ভিসায় কোন বন্দরের কথা লিখা আছে সেটা বিবেচনায় আসবে না। কিন্তু এই তিনটি ছাড়া অন্য কোন বন্দর ( যেমন হিলি, সোনা মসজিদ) দিয়ে আপনি ভারত প্রবেশ করতে চাইলে সেটি অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে ভিসা আবেদনের সময়।
৪. অনলাইন আবেদন এর ছবি এবং ফর্ম এ আঠা দিয়ে লাগানো ছবি একই হতে হবে। ছবিতে চশমা পরার নিয়ম নেই। অনেক সময় চশমা পরা ছবি দিয়ে পার পেয়ে জেতে পারেন, কিন্তু ঝামেলা হবার সম্ভাবনা থেকেই যায়।
৫. কিছু সময় হাতে রেখে ভিসা করতে দিন কারন অনেক সময় ভিসা করতে অতিরিক্ত সময় লেগে যায়।
৬. প্রথমবার মেডিকেল ভিসা নিয়ে যেতে চাইলে সাধারনত বাংলাদেশি ডাক্তার এর রেফার লেটার লাগেই, কিন্তু পরেরবার থেকে ইন্ডিয়ান ডাক্তারের রেফার লেটার ও এপয়েন্টমেন্ট হলেই হবে।
৭. ভিসার আবেদন এর কাগজপত্র জমা দেয়ার একটি নির্দিষ্ট ক্রম আছে , সেটা মেনে কাগজ সাজান।
কোলকাতা গমনঃ কোলকাতা যাবার জন্য আপনাদের হাতে কয়েকটি বেছে নেবার সুযোগ আছে। সেগুলো হল – বাস, ট্রেন ও ব্যাক্তিগত পরিবহন। প্রতিটির আলাদা আলাদা ভাল ও খারাপ দিক আছে। আমি সংক্ষেপে সেগুলো বলার চেষ্টা করছি।
বাসঃ বাসে যাবার সবচেয়ে বড় সুবিধা হল আপনার বেছে নেবার অনেক সু্যোগ। প্রতিদিন প্রচুর বাস চলাচল করে ঢাকা থেকে কোলকাতা রুট এ । আর বাস বিভিন্ন যায়গা থেকে ছাড়ে সুতরাং দেশের ভেতরে আপনার অবস্থান অনুযায়ী আপনি সুবিধামত যায়গা থেকে বাস এ যেতে পারবেন। ভাড়া বাস ভেদে বিভিন্ন রকম আছে। সবচেয়ে বেশি ভাড়া ডিরেক্ট বর্ডার পার হওয়া গাড়িগুলোতে। এই গাড়িগুলোর ইকোনমি এসি এর ভারা ১৯০০ টাকা (বেনাপোল-পেট্রাপোল হয়ে) । সাধারন সব বাসের একি নিয়ম, তারা আপনাকে স্থল বন্দরে নামায়ে দিবে এবং সীমান্ত পার হবার যেসব নিয়মকানুন আছে সেগুলো পূরনে আপনাদের সাহায্য করবে। সাথে পার হবার পরে একই কোম্পানির অন্য একটি বাস সিমান্তের ওপার থেকে আপনাদের নিয়ে যাবে। ডিরেক্ট বাসের ব্যাপারটা একটু ভিন্ন, এক্ষেত্রে আপনি যে বাসে যাচ্ছেন সেই বাসটি সীমান্ত পার হয়ে আপনাদের কোলকাতা পৌছে দেবে। এই বাসগুলো আপাতত শুধুমাত্র বেনাপোল বর্ডার দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে। বেনাপোল সীমান্ত দিয়েই যেহেতু সবচেয়ে বেশি লোক ভারতে প্রবেশ করে তাই সীমান্ত অতিক্রমে অনেক সময় লেগে যায়। আবার সীমান্তের ওপারে যশোর রোড বেশ সরু তাই অনেকটা সময় লেগে যায় কোলকাতা পৌছাতে (৫-৬ ঘন্টাও লাগতে পারে গাড়ির চাপ বেশি থাকলে) । তবে বাস এ গেলে আপনি সীমান্ত পার হবার পরে আপনার সুবিধামত সময়ে নেমে যেতে পারবেন। আর বাস এর শেষ স্টপেজ যেটা নিউ মার্কেট নামে পরিচিত সেখানে প্রচুর হোটেল, মানিএক্সচেঞ্জ এবং ভ্রমণকারীদের প্রয়োজনীয় অন্যান্য সুযোগ সুবিধা আছে। তাই বাস থেকে নেমে আপনার অন্য কোথাও যেতে হবে না। কোম্পানী ভেদে ১৫ থেকে ৩০ দিন আগে টিকিট বুক করতে পারবেন।
ট্রেনঃ ট্রেন এ ভারতে যাওয়া অনেকটাই সহজ হয়ে গেছে এখন। বিমানবন্দরের মত এন্ড-এন্ড ইমিগ্রেশনের কারনে। এর মানে হল আপনি ঢাকা থেকে ইমিগ্রেশন-কাস্টমস শেষ করে বোর্ডিং পাস নিয়ে ট্রেন উঠে বসবেন এবং একেবারে কোলকাতা স্টেশনে গিয়ে নেমে ইমিগ্রেশন-কাস্টমস শেষ করে বেরিয়ে যাবেন। মাঝে বর্ডারে নামা-উঠার কোন ঝামেলা নেই আর যেহেতু শুধু মাত্র ট্রেনের যাত্রিরাই এই পথে ভারতে প্রবেশ করেন তাই ভিড় ও তুলনামুলক কম। ট্রেন এর মান ও বেশ ভাল। ঢাকা-কোলকাতা মৈত্রি এক্সপ্রেস সপ্তাহে ৪ দিন (শুক্র, শনি, রবি, বুধ) ও খুলনা কোলকাতা বন্ধন এক্সপ্রেস আপাতত সপ্তাহে ১ দিন (বৃহষ্পতিবার) ভারত যায়। সুতরাং আপনি যদি ঢাকা বা খুলনার আসেপাশে না থাকেন তবে আপনার জন্যে ট্রেন এ যাওয়াটা হয়ত অতটা সুবিধার হবে না। ট্রেন এর টিকিট কাটতে হলে আপনাকে সশরীরে কমলাপুর ষ্টেশনে পাসপোর্ট এর মুল কপি নিয়ে এসে তারপরে কাটতে হবে। ঠিক ২৯ দিন আগে টিকিট বিক্রি শুরু হবে ( ২৯ ই ৩০ নয়, অনেকেই বলেন ৩০ কিন্তু সফটওয়ার এর জটিলতার কারনে আসলে ২৯ দিনের আগে টিকিট বিক্রি করতে পারে না ওরা) । একজন সর্বোচ্চ ৪ টি টিকিট কাটতে পারবেন। এবং যাদের টিকিট কাটবেন তাদের সবার পাসপোর্ট লাগবে।
সীমান্তের নিয়মকানুন ঠিকমত জানা থাকলে ব্যাক্তিগত ব্যাবস্থায় সীমান্তে গিয়েও আপনি সীমান্ত পার হতে পারবেন। ইমিগ্রেশন/কাস্টমস অফিসের কোন কর্মকর্তা ছাড়া কখোনই কারো কাছে আপনার পাসপোর্ট দেবেন না। কেউ দেখতে চাইলে আগে তার পরিচয় নিশ্চিত হয়ে তারপরে দেখাবেন। আর অফিসের বাইরে কারো কাছেই দেবেন না। এবং যে যাই বলুক বর্ডার থেকে বেশি ডলার ভাঙ্গাবেন না। বর্ডারে অনেক কম রেট পাওয়া যায়।
বিমানঃ ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে কোলকাতা ও চেন্নাই যাবার বেশ কিছু ফ্লাইট রয়েছে। এছাড়া ভারতের অন্যান্য কিছু স্টেট এর সাথেও ফ্লাইট রয়েছে। তবে সরাসরি ফ্লাইট মুলত কোলকাতার গুলোই। অন্যগুলোতে অনেক সময়ই স্টপ থাকে। বিমানের ভাড়া ডাইনামিক প্রাইসিং হবার কারনে নির্দিষ্ট ভাড়া বলা কঠিন। তবে ঢাকা-কোলকাতা সর্বনিন্ম ৫৫০০-৬০০০ ও ঢাকা-চেন্নাই সর্বনিন্ম ১২০০০-১৩০০০ এ পেতে পারেন। এবং চট্টগ্রাম-কোলকাতা সর্বনিন্ম ১১০০০-১২০০০ টাকা ও চট্টগ্রাম-চেন্নাই ২০০০০ টাকায় পেতে পারেন। মনে রাখবেন এগুলো গড় ভাড়া নয়। সম্ভাব্য সর্বনিন্ম ভাড়া যেটা আপনি চাহিদার সল্পতা ও অনেক আগে বুকিং এর ক্ষেত্রে পেতে পারেন।
কোলকাতায় থাকাঃ বাংলাদেশ থেকে যারা কোলকাতা যান তাদের একটা বড় অংশই নিউমার্কেট এলাকায় থাকেন। এর কারন বাসগুলো এখানেই এসে থামে। সেই মতই এই এলাকার সমস্ত কিছু গড়ে উঠেছে। এবং চিকিৎসা বা ভ্রমন যে কারনেই আসেন না কেন নিউমার্কেট এলাকায় আপনার থাকা সবচেয়ে সুবিধাজনক হবে কারন আপনার প্রয়োজনীয় সবকিছুই এখানে হাতের কাছে পাবেন এবং অনেক হোটেল-গেস্ট হাউস থেকে পছন্দ করে নিতে পারবেন। তবে এই এলাকার ভাড়া অন্যান্য এলাকার তুলনায় কিছুটা বেশি। এছাড়াও এয়ারপোর্ট এলাকা তেও অনেক হোটেল লজ আছে। অই দিকটাতে খরচ একটু কম। বিমানে যাতায়াত করলে এয়ারপোর্ট এর আসেপাশে থাকতে পারেন। এছাড়াও অনেক বাড়িতে আপনি পেয়িং গেস্ট হিসেবেও থাকতে পারবেন। যেহেতু বাংলাদেশ ও কোলকাতার সংস্কৃতি অনেকটা একিরকম তাই পেয়িং গেস্ট হিসেবে থাকতেও আপনার খারাপ লাগবে না।
পরবর্তি পার্ট এর জন্যে সাথে থাকুন