বিটকয়েন কিভাবে কাজ করে?
গত বছরের শুরুর দিকে টেকপাড়ায় একটা বিষয় নিয়ে বেশ হইচই পড়ে যায়, যখন টেকজায়ান্ট টেসলার কর্ণধার এলন মাস্ক ঘোষণা করেন তিনি প্রায় ১.৫ বিলিয়ন ডলার দিয়ে ‘বিটকয়েন’ কিনেছেন। তার ঘোষণার পর থেকেই হুহু করে বেড়ে যায় ‘বিটকয়েন’-এর দাম। তো আজ আলোচনা করবো বিটকয়েন কি এবং বিটকয়েন কিভাবে কাজ করে?
আসলে এই ‘বিটকয়েন’ জিনিসটা কি? আর কিভাবেই এটা কাজ করে? চলুন জেনে নেয়া যাক!
বিটকয়েন কি ?
বিটকয়েন(Bitcoin) একধরনের ডিজিটাল মুদ্রা যা অন্য যে কারো নিয়ন্ত্রণ ছাড়া ও কোনও সরকারের কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনার হস্তক্ষেপ ছাড়াই পরিচালিত হয়। এটি মূলত পিয়ার টু পিয়ার ( p2p বা peer to peer ) সফটওয়্যার ও ক্রিপটোগ্রাফির মাধ্যমে পরিচালিত হয়।
সকল বিটকয়েন লেনদেনের একটি পাবলিক লেজার সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা কম্পিউটার সার্ভারে সংরক্ষিত থাকে। সারা বিশ্বের যে কেউ তার কম্পিউটারকে এর সার্ভারে পরিণত করতে পারে যেটাকে ‘নড’ বলা হয়। যারা বিটকয়েন কেনেন তারা ব্যাংকের মতো কোন কেন্দ্রীয় সোর্স ছাড়াই ছড়িয়ে থাকা এই নডগুলোর সাথে ক্রিপটোগ্রাফির মাধ্যমে যুক্ত হন।
সকল লেনদেনগুলো পাবলিকলি এই নেটওয়ার্কে প্রচার হয়ে যায় এবং সকল নডে পৌঁছে যায়। প্রতি দশ মিনিট অন্তর বা কাছাকাছি সময়ে এই ট্রানজেকশগুলো মাইনাররা একটা গ্রুপের মাধ্যমে সংগ্রহ করে যেটাকে ‘ব্লক’ বলা হয়। এর ব্লকচেইনে এটা স্থায়ীভাবে যুক্ত হয়ে যায়। সহজভাবে এভাবেই বিটকয়েনের হিসাবকে সংজ্ঞায়িত করা যায়।
আপনি আপনার পকেটে যেভাবে টাকা পয়সা রাখেন, ডিজিটাল মুদ্রা রাখার জন্যও এক ধরনের ওয়ালেট রয়েছে। যেটা ডিজিটাল মুদ্রার মালিক তার ক্লায়েন্ট সফটওয়্যারের মাধ্যমে একসেস করতে পারে। বিটকয়েনের ক্ষেত্রে বিষয়টা একটু ভিন্ন। এটার ক্ষেত্রে সেরকম কোনো ওয়ালেট নেই। এটা শুধু নেটওয়ার্কের সাথে এটার মালিকানার একটি চুক্তিমাত্র।
বিটকয়েন লেনদেন হয় শুধুমাত্র একটা ‘প্রাইভেট কী’ এর মাধ্যমে। যে কেউ যদি এই ‘কী’ মুখস্থ রাখতে পারে তাহলে তার ফিজিকাল বা ডিজিটাল কোনো ওয়ালেটেরই আর প্রয়োজন পড়ে না। এজন্য এ ধারণাটিকে ‘ব্রেইন ওয়ালেট’ বলা হয়।
বিটকয়েনের উদ্ভাবক কে?
২০০৮ সালে bitcoin.org ডোমেইন নেমটি কেনা হয় এবং ‘বিটকয়েনঃ এ পিয়ার টু পিয়ার ইলেক্ট্রনিক ক্যাশ সিস্টেম’ নামে একটি শ্বেতপত্র এতে আপলোড করা হয়। এখানে কোনো কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা বা সরকারের হস্তক্ষেপ ছাড়া কিভাবে ডিজিটালি লেনদেন করা সম্ভব সেই থিওরি সম্পর্কে জানানো হয়। সাতোশি নাকামোতো নামে এগুলো আপলোড করা হয়।
পরের বছর ৯ই জানুয়ারি ২০০৯ তারিখে বিটকয়েন সফটওয়্যার জনসম্মুক্ষে প্রকাশ করা হয়। নাকামোতো ২০১০ সাল পর্যন্ত এই প্রজেক্টে যুক্ত থাকেন।
এরপর অন্য ডেভেলপারদের হাতে দায়িত্ব দিয়ে তিনি এই প্রজেক্ট থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন।
কিন্তু সাতোশি নাকামোতো নিজের বা নিজেদের নাম গোপন রাখার কারনে এই নামের পেছনে কে বা কারা ছিলেন তা আজ পর্যন্ত কেউ জানে না।
এখন বিটকয়েন সফটওয়্যার ওপেন সোর্স সফটওয়্যার। এর অর্থ যে কেউ চাইলে এর কোডিং ব্যবহার বা আরো উন্নত করতে পারে সম্পূর্ণ ফ্রিতে। সারা বিশ্বের অসংখ্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এখন এর উন্নয়নে নিযুক্ত আছেন, যার মধ্যে এমআইটি’র মতো প্রতিষ্ঠানও আছে।
বিটকয়েন কিভাবে কাজ করে?
বিটকয়েন ব্লকচেইন টেকনোলজি ব্যবহার করে সকল মধ্যস্থকারীদের বাদ দিয়ে কাজ করে।
বর্তমান অর্থব্যবস্থায় আপনার যদি ফান্ড ট্রান্সফার করার প্রয়োজন পড়ে তাহলে আপনি কোনো মধ্যস্থকারী যেমন, ব্যাংক অথবা অন্য কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান যুক্ত থাকে। আর যখনই এ ধরনের মধ্যস্থকারী যুক্ত হয় তখনই লেনদেনের ক্ষেত্রে তাদের জন্য আলাদা খরচের সৃষ্টি হয়।
এই মধ্যস্থকারীদের সরিয়ে বিটকয়েন সিপিইউয়ের কম্পিউটিংয়ের মাধ্যমে ক্রিপ্টোগ্রাফিক পদ্ধতিতে লেনদেনের মাধ্যমে দারুণ এক আস্থার জায়গায় পরিণত হয়ে গেছে। আর এতে লেনদেনের জন্য আলাদাভাবে খরচ করার প্রয়োজনও নেই।
বিটকয়েনের জন্য শুধুমাত্র একটি ওয়ালেট, একটি “পাবলিক কী’ ও একটি ‘প্রাইভেট কী’ প্রয়োজন পড়ে। যে কেউ বিটকয়েন প্রোগ্রাম হতে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে বিটকয়েন ওয়ালেট ডাউনলোড করতে পারে। যেটাতে একটা ‘পাবলিক কী’ ও একটা ‘প্রাইভেট কী’ সংযুক্ত থাকে।
‘পাবলিক কী’ হলো মূলত একটা এড্রেস যেটা ব্যাংক একাউন্ট নাম্বারের মতো ব্যবহার করে যেকেউ বিটকয়েন রিসিভ করতে পারে। আর ‘প্রাইভেট কী’ হলো বিটকয়েন ব্যবহারকারীর একটি ডিজিটাল সিগনেচারের মতো যেটা ব্যবহার করে সে বিটকয়েন সেন্ড করতে পারে।
বিটকয়েন রিসিভ করার জন্য পাবলিক কী যে কারো সাথে শেয়ার করা যেতে পারে কিন্তু প্রাইভেট কী শুধুমাত্র এর মালিকের কাছেই গোপনীয় থাকে। আপনি যত হ্যাকিংয়ের ঘটনা পাবেন সব এই প্রাইভেট কী চুরির মাধ্যমে ঘটেছে, বিটকয়েন নেটওয়ার্কের নয়। কেননা, আগেই বলেছি , বিটকয়েন নেটওয়ার্ক হ্যাক করা বর্তমান সময়ের কম্পিউটার দ্বারা সম্ভব নয়।
এই বিটকয়েনের এড্রেস দ্বারা এর মালিককে খুঁজে বের করা সম্ভব নয়, যদিওবা সেই এড্রেস দ্বারা সংঘটিত সকল লেনদেনের রেকর্ড ব্লকচেইনে থাকে। ২০০৯ সালে বিটকয়েন যাত্রা শুরু করার পর থেকে এ পর্যন্ত যতগুলো লেনদেন হয়েছে সেগুলো একটি লেজারে সংরক্ষিত থাকে।
যেটাকে মুছে ফেলা বা পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। এই লেনদেনগুলোর লেজারগুলো সারাবিশ্বে ছড়িয়ে থাকা নডে সংরক্ষিত হয়ে যায় আর এটাই হলো ব্লকচেইন।
বিটকয়েনের উদ্দেশ্য কি?
বিটকয়েন যাত্রা শুরু করে মূলত ইন্টারনেটের মাধ্যমে অর্থ লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে। এই ডিজিটাল মুদ্রাটি অন্যান্য ডিজিটাল মুদ্রা যেগুলো কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় তার বিকল্প হিসেবে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে।
বিটকয়েনকে কি প্রচলিত মুদ্রায় পরিণত করা যায়?
জ্বি, যায়। অন্যান্য সকল সম্পদের মতো বিটকয়েনকেও সাধারণ প্রচলিত মুদ্রায় পরিণত করা যায়। বর্তমানে অনলাইনে অসংখ্য ক্রিপ্টো কারেন্সি এক্সচেঞ্জার রয়েছে। এই এক্সচেঞ্জারগুলোতে আপনি সরাসরি কারো কাছে বা কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে আপনার বিটকয়েন বিক্রি করতে বা কিনতে পারেন। সেটা যতই কম পরিমাণই হোক না কেনো। তবে বিটকয়েনকে সরাসরি অর্থে রূপান্তরিত করার কোনো পদ্ধতি নেই।
এটা ঠিক যে কেউ একেবারে ১০০% নিশ্চিত হয়ে বিটকয়েনের স্ট্যাবিলিটি সম্পর্কে বলতে পারবে না। তবে আবার এটাও সত্য যে ‘গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড’ বাদ দিলে অন্য স্ট্যান্ডার্ড কারেন্সি যেমন, ইউএস ডলার, ইউকে পাউন্ড এগুলোর ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য।
বিটকয়েন কি নিরাপদ?
বিটকয়েন যে ক্রিপ্টোগ্রাফি দিয়ে চলে তা ইউএস ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সির বানানো SHA-256 এলগরিদমের ভিত্তিতে। যেকোনো উদ্দেশ্যেই এটা ক্র্যাক করা অসম্ভব। কারণ পুরো মহাবিশ্বে যত এটম আছে (আনুমানিক ১০৭৮ থেকে ১০৮২) এই এলগরিদমের তার চেয়েও বেশি সম্ভাব্য প্রাইভেট কী (২২৫৬) পরীক্ষা করতে হবে।
আমরা খুঁজলে অবশ্য অনেকগুলো বিটকয়েন এক্সচেঞ্জ হ্যাকিংয়ের ঘটনা খুঁজে পাবো৷ কিন্তু এই হ্যাকিংগুলো কাস্টমারদের একাউন্ট হ্যাকিংয়ের ঘটনা বিটকয়েন নেটওয়ার্কের হ্যাকিংয়ের নয়।
বিটকয়েনের সমস্যাগুলো কি কি?
বিটকয়েনের অনেক সমালোচনা হয়েছে যার প্রধান কারণের মধ্যে রয়েছে, এটা প্রচুর পরিমাণে এনার্জি খরচ করে। ইউনিভার্সিটি অব ক্যামব্রিজের একটি এনার্জি খরচের ট্র্যাকার রয়েছে যেটাতে দেখা যায় ২০২১ সালের শুরুর হিসাবে দেখা যায় এটি বার্ষিক প্রায় ১০০ টেরাওয়াট ঘন্টা এনার্জি ব্যয় করে। এই এনার্জি আসলে কত তা একটা উদাহরণ দিলে বুঝতে পারবেন। ২০১৬ সালে পুরো ইংল্যান্ডে ৩০৪ টেরাওয়াট ঘন্টা এনার্জি খরচ হয়।
একে বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কাজের সাথে জড়ানো হয়। যেহেতু এর আসল মালিকের ট্রেস পাওয়া সম্ভব নয় তাই কালোবাজারে ব্যপকভাবে এটার ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। যেখানে প্রচলিত লেনদেনের ক্ষেত্রে লেনদেনকারির পরিচয় জানা সম্ভব।
বিটকয়েন কি বাংলাদেশে বৈধ?
যদিও বহিবিশ্বের অনকে বড় বড় কম্পানি ক্রিপ্টকারেনসি তথা বিটকয়েন ব্যবহার করছে, কিন্তু এখনও বাংলাদেশ সহ বিশ্বের বেশ কিছু দেশে বিটকয়েন ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে । এমনকি অনেক দেশের গয়েন্দারা বিটকয়েন ব্যবহার কারিদের খুজে বেড়াচ্ছে । আর তাই বাংলাদেশে বিটকয়েন এর বৈধতা সম্পর্কে বলাযায় এটি বাংলাদেশে বৈধ নয় ।
বিটকয়েন বা ক্রিপ্টোকারেন্সি বর্তমান প্রচলিত অর্থব্যবস্থাকে পুরোপুরি বদলে দিচ্ছে। বিশ্বের অনেক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এখন একে অনুমোদন দিচ্ছে। যদিও সকল দেশ এখনো একে পুরোপুরো গ্রহণ করেনি। তবে অদূর ভবিষ্যতে ক্রিপ্টোকারেন্সিই হবে সকল প্রকার লেনদেনের মূদ্রা এতে কোনো সন্দেহ নেই।