মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালামপুরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এই টুইন টাওয়ারটি ২০ বছরের বেশি সময় ধরে দেশটির জাতীয় প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। বিশ্বের বেশ কয়েকটি উচ্চতা বিশিষ্ট টুইন টাওয়ারের মধ্যে এটি একটি। আজকে আমরা পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার সম্পর্কে জানার চেষ্টা করব।
০১ জানুয়ারি ১৯৯২ সালে পেট্রোনাস টুইন টাওয়ারের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হয়। কিন্তু প্রশাসনিক জটিলতা কাটিয়ে ১৯৯৩ সালের ০১ মার্চ তারিখে এর নির্মাণ কাজ আরম্ভ হয়। একটি ঘোড় দৌড়ের ময়দানকে পেট্রোনাস টুইন টাওয়ারটি তৈরির জন্য বেছে নেয়া হয়। জায়গাটি পাহাড়ের পাশে হওয়ায় এর মাটির মূল উপাদান ছিল ক্ষয়ে যাওয়া চুনাপাথর ও নরম শিলা। স্থপতিরা টাওয়ার নির্মাণ কাজ শুরুর প্রাক্কালে একটি বড় ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হন। এর মাটির গঠনের কারণে মেগা স্ট্রাকচারটি সঠিকভাবে স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। সমস্যাটির সমাধান করতে ঘোড় দৌড়ের মূল স্থান হতে ভিত্তি প্রস্তরগুলোকে প্রায় ২০০ ফুট দূরে সরিয়ে নেওয়া হয়।
পেট্রোনাস টুইন টাওয়ারের নকশা তৈরি করেন আর্জেন্টিনার নকশাবিদ সিজার পেলি। সিজার পেলি এই টাওয়ারটি নকশা করার সময় ভবনটিকে ভূমিকম্প সহনশীল করতে বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত বিখ্যাত নকশাবিদ ও স্থপতি ফজলুর রহমানের আবিষ্কার করা টিউব ইন টিউব পদ্ধতি প্রয়োগ করেন। সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হচ্ছে, মালয়েশিয়ার পূর্ববর্তী প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ টুইন টাওয়ারকে সুউচ্চ ভবন হিসেবে নির্মাণ করতে চাননি, তিনি এখানে মালয়েশিয়ার সংস্কৃতির প্রতিফলন ঘটাতে চেয়েছিলেন। এজন্য মুসলিম প্রধান দেশ মালয়েশিয়ার এই সুবিশাল টাওয়ারের নকশাতে ইসলামিক প্রভাব প্রতিফলিত হয়। ইসলাম ধর্মের পাঁচটি স্তম্ভকে সামনে রেখে এটির নকশা করেন সিজার পেলি। স্থপতি সিজার পেলি নকশার প্রতিটি ক্ষেত্রেই মুসলিম স্থাপত্যশৈলী এবং শিল্পকর্মকে অনুপ্রেরণা হিসেবে বিবেচনা করেছেন। উদাহরণস্বরুপ: এই টাওয়ারটির সামনের দিকে ইস্পাত ও কাঁচের অবকাঠামোটির কথাই বলি, টুইন টাওয়ারটির সম্মুখ ভাগে আধুনিক ইসলামী স্থাপত্য নকশার অনন্য উদাহরণ বলা হয়ে থাকে। আরও একটি বিস্ময়কর তথ্য হচ্ছে, এর নির্মাণ কাজ একটি প্রতিষ্ঠান দ্বারা সম্পন্ন হয়নি। নির্মাণ কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করতে মালয়েশিয়ান সরকার দুটি আলাদা কোম্পানীকে দায়িত্ব প্রদান করেন। টাওয়ারটির পশ্চিম পাশের অংশটি জাপানী কোম্পানী হাজামা কর্পোরেশন এবং পূর্ব অংশটি দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানী স্যামসাং সি এন্ড টি কর্পোরেশন নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেন। দুটি প্রতিষ্ঠান একসাথে কাজ করলেও সম্পূর্ণ কাজটি শেষ করতে প্রায় ৭ বৎসর সময় অতিবাহিত হয়।
স্থাপত্যকর্মের কাঠামোটিতে ৮ লক্ষ ৯৯ হাজার বর্গফুট স্টেইনলেস স্টীল ব্যবহৃত হয়। এই টাওয়ারটি সুউচ্চ হওয়ার কারণে স্বাভাবিকভাবেই অনেক বেশি উত্তপ্ত হয়। টাওয়ারটির চারপাশে ৫ লক্ষ ৯০ হাজার বর্গফুট আয়তনের বিশেষ ধরনের কাচ বসানো হয়েছে যাতে ক্ষতিকারক অতি বেগুনি রশ্মির প্রতিফলন এবং তাপমাত্রা যেন কম হয়। কাচের এই অবকাঠামো টাওয়ারটিকে শীতল রাখে। নির্মাণ শেষ হওয়ার পর পেট্রোনাস টুইন টাওয়ারের উচ্চতা হয় ১ হাজার ৪ শত ৮৩ ফুট যেটি তৎকালীন সময়ে মানব নির্মিত কাঠামোগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ছিল। পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার নির্মাণে ব্যয় হয় প্রায় ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। মালয়েশিয়ান প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ ১৯৯৯ সালের ৩১ আগস্ট এই টাওয়ারটির শুভ উদ্বোধন করেন। উদ্বোধন হওয়ার পর পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই পুরো বিশ্বের কাছে একটি জনপ্রিয় টাওয়ারে পরিচিত লাভ করে। এমনকি ২০০৪ সাল পর্যন্ত পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার গোটা বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ ইমারত ছিল।
পেট্রোনাস টুইন টাওয়ারের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হচ্ছে, এর ৪১ এবং ৪২ তলায় রয়েছে একটি স্কাই ব্রিজ। এই ব্রিজটি টাওয়ারের দুইটি অংশকে একে অপরের সাথে যুক্ত করেছে। ব্রিজটি বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থিত। এই টাওয়ারটিতে সর্বমোট ৩২ হাজার জানালা রয়েছে। সবগুলো জানালা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে অন্ততঃ দুই মাস সময় অতিবাহিত হয়। টাওয়ারটি ৮৮ তলা বিশিষ্ট। টাওয়ারটির ৮৬ তলা থেকে সমস্ত কুয়ালালামপুর শহরটিকে এক নজরে পর্যবেক্ষণ করা যায়। প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ পর্যটক টিকিট কেটে পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার পরিদর্শন করতে পারেন। আর এ কারণে পর্যটকরা খুব সকাল হতে টিকিট কাটার জন্য এখানে লাইনে অবস্থান করে।
টুইন টাওয়ারের নামী দামী বহুজাতিক কোম্পানীগুলোর বেশ কিছু সংখ্যক অফিস রয়েছে। এই অফিসগুলোতে কয়েক হাজার কর্মী চাকরি করে। এদের মধ্যে মালয়েশিয়ার জাতীয় তেল উৎপাদনকারী কোম্পানী পেট্রোনাস অন্যতম। মূলতঃ এই কোম্পানীর নামানুসারে টাওয়ারটির নামকরণ করা হয়েছে পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার। এগুলো ছাড়াও আল জাজিরা, আইপিএম, মাইক্রোসফট, রয়টার্সসহ অনেকগুলো বিখ্যাত কোম্পানীর অফিস এখানে অবস্থিত। সবকিছু মিলিয়ে পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার কেবলমাত্র স্থাপত্য বিষয়ই নয়, এটি মালয়েশিয়ার গর্ব এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাবিকাঠি।