রোজা রমজান সিয়াম

ফারসি শব্দ রোজার আরবি অর্থ হচ্ছে সওম, বহুবচনে সিয়াম। সওম বা সিয়ামের বাংলা অর্থ বিরত থাকা। আর সিয়াম সাধনার অর্থ– সুবহেসাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল ধরনের পানাহার, পাপাচার এবং খারাপ কাজ থেকে নিজেকে বিরত ও সংযত রাখা। এ পবিত্র মাস মানুষকে সকল রকম গর্হিত ও অনৈতিক কার্যকলাপ থেকে বিরত রাখে এবং সকলকে সাধ্যমত ইবাদাত বন্দেগি করার জন্য উৎসাহিত করে।


রমজান মাস

আরবি ক্যালেন্ডার এর নবম মাস রমজান মাস। রমজান মাসের সিয়াম সাধনা হল ইসলামের পাঁচটি খুটির একটি।  মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ একটি মাস হল এই রমজান মাস।  এ মাসে মুসলমানরা সুভে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল পানাহার এবং অন্যান্য  শারীরিক চাহিদা থেকে বিরত থাকে। তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য মহান আল্লাহ তাআলাকে রাজি ও খুশি করা।

রমজান মাসে রোজা রাখা শুধুমাত্র একটি শারীরিক কাজ নয় বরং একটি আধ্যাত্মিক কাজও। কারণ মুসলমানদেরকে আল্লাহর সাথে তাদের সম্পর্ক স্থাপন করার জন্য, ক্ষমা চাওয়ার জন্য এবং তাদের বিশ্বাসকে গভীর করার জন্য সময় ব্যয় করতে উত্সাহিত করা হয়। মুসলমানরাও এই মাসে বেশি বেশি সালাত আদায় করে এবং কোরআন তেলাওয়াত করে।  এর কারণ হলো রমজান মাসে ভাল কাজের পুরষ্কার বহুগুণ বেড়ে যায়।

৬৪ জেলার রমজান ক্যালেন্ডারhttps://kivabe.com/ramadan/

রমজান মাসের ইতিহাস

রমজান মাসের সিয়াম সাধনা ১৪০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মুসলমানরা পালন করে আসছে। যদিও পূর্ববর্তী উম্মতেরাও সিয়াম সাধনা করতেন কিন্তু হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উম্মতের উপর সিয়াম ফরজ করা হয়েছে। ৬১০ খ্রিস্টাব্দে শেষনবী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন মক্কার হেরা পাহাড়ের একটি গুহায় ধ্যান করছিলেন তখন তাঁর উপর কুরআনের প্রথম পাঁচটি আয়াত নাজিল হয়েছিল।

কখন থেকে রমজান বাধ্যতামূলক হলো?

রমজানে সিয়াম পালন প্রাথমিকভাবে বাধ্যতামূলক ছিল না, কিন্তু ইসলামী ক্যালেন্ডারের দ্বিতীয় বছরে সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমানদের জন্য এটি বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। আত্মশৃঙ্খলা, দরিদ্র এবং ক্ষুধার্তদের জন্য আরও বেশি সহানুভূতিশীল হিসেবে গড়ে তোলা এবং আল্লাহর সাথে একজনের বিশ্বাস এবং আধ্যাত্মিক সংযোগকে আরও গভীর করার উদ্দেশ্যে সিয়াম সাধনা করা হয়।

রমজানের গুরুত্ব

সারা বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ মুসলমান আধ্যাত্মিক প্রতিফলন, আত্ম-শৃঙ্খলা এবং সম্প্রদায়ের সাথে সৌহার্দ্য গড়ে তোলার জন্য সিয়াম পালন করে। রমজানের রোজা মুসলমানদের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করতে, ক্ষমা চাইতে এবং আল্লাহর নিকটবর্তী হতে সাহায্য করে। রমজান হল এমন একটি সময় যখন মুসলমানরা তাদের  সিয়াম ভঙ্গ করতে ইফতার করার সময় এবং  সালাত আদায় করতে একত্রিত হয়। এটি  মুসলিম সম্প্রদায়ের বন্ধনকে শক্তিশালী করতে এবং একতা ও ভ্রাতৃত্ববোধকে  দৃঢ় করতে সহায়তা করে। রমজানের রোজা মুসলমানদের তাদের জীবনে  আল্লাহ সুবহানা  ওয়া তায়ালার যে  রহমত রয়েছে তা উপলব্ধি করতে এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে সহায়তা করে।  সিয়াম সাধনার জন্য শৃঙ্খলা এবং আত্ম-নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন, যা মুসলমানদের তাদের জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও এই গুণাবলী বিকাশে সাহায্য করতে পারে। সিয়াম পালনকালে উপবাসের মাধ্যমে, মুসলমানরা ক্ষুধা ও তৃষ্ণা অনুভব করে, যা তাদের  অসহায় ও দরিদ্রদের প্রতি সহানুভূতি  প্রকাশে সাহায্য  করে এবং তাদের আরও  দান খয়রাত ও সহানুভূতিশীল হতে উত্সাহিত  করে।

পবিত্র রমজানের ফজিলত ও মর্যাদা সম্পর্কে হাদিসের কিতাবগুলোতে অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। এর ভেতর থেকে কিছু হাদিস এখানে উল্লেখ করা হলো-

 

প্রিয় নবীজি (সা.) এর প্রিয় সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেছেন, রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন, যখন রমজান মাস আসে আসমানের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয় এবং দোজখের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়, আর শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয়। (বুখারী, মুসলিম)

 

অপর হাদিসে এসেছে, হযরত সাহ্ল ইবনে সা’দ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারীম (সা.) এরশাদ করেছেন, বেহেশতের ৮টি দরজা রয়েছে। এর মধ্যে ১টি দরজার নাম রাইয়ান। রোজাদার ব্যতিত আর কেউ ওই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। (বুখারী, মুসলিম)

 

বিখ্যাত হাদিস বিশারদ সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেছেন, হুজুর (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে ও সওয়াবের নিয়তে রমজান মাসের রোজা রাখবে তার পূর্বের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে ও সওয়াবের নিয়তে রমজান মাসের রাতে এবাদত করে তার পূর্বের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে ও সওয়াবের নিয়তে কদরের রাতে ইবাদত করে কাটাবে তার পূর্বের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। (বুখারী, মুসলিম)

 

হাদিসে আরও এসেছে, রাসুল (সা.) বলেন, রোজা সম্পর্কে আল্লাহ স্বয়ং এরশাদ করেছেন: “রোজা আমার জন্যে এবং আমিই তার পুরস্কার দান করবো।”  রোজা (জাহান্নামের আজাব থেকে বাঁচার জন্য) ঢাল স্বরুপ। তোমাদের কেউ রোজা রেখে অশ্লীল কথাবার্তায় ও ঝগড়া বিবাদে যেন লিপ্ত না হয়। কেউ তার সঙ্গে গালমন্দ বা ঝগড়া বিবাদ করলে শুধু বলবে, আমি রোজাদার।

 

অপর একটি হাদিসে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলে পাক (সা.) বলেছেন, রোজা এবং কোরআন (কেয়ামতের দিন) আল্লাহর কাছে বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোজা বলবে, হে পরওয়ারদিগার! আমি তাকে (রমজানের) দিনে পানাহার ও প্রবৃত্তি থেকে বাধা দিয়েছি। সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন। কোরআন বলবে, আমি তাকে রাতের বেলায় নিদ্রা হতে বাধা দিয়েছি। সুতরাং আমার সুপারিশ তার ব্যাপারে কবুল করুন। অতএব, উভয়ের সুপারিশই কবুল করা হবে এবং তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে। (বায়হাকী)

 

হাদিস শরীফে আরও এসেছে, হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, যখন রমজানের প্রথম রাত আসে শয়তান ও অবাধ্য জিনদের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা হয়। দোজখের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। অতঃপর এর কোনো দরজাই খোলা হয় না। বেহেশতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়। অতপর এর কোনো দরজাই বন্ধ করা হয় না। এ মাসে এক আহ্বানকারী আহ্বান করতে থাকে, হে ভালোর অন্বেষণকারী! অগ্রসর হও। হে মন্দের অন্বেষণকারী! থামো। আল্লাহ তায়ালা এ মাসে বহু ব্যক্তিকে দোযখ থেকে মুক্তি দেন। আর এটা এ মাসের প্রতি রাতেই হয়ে থাকে। (তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ)

 

হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন, যখন রমজান মাস উপস্থিত হতো রাসুল (সা.) সমস্ত কয়েদিকে মুক্তি দিতেন এবং প্রত্যেক প্রার্থনাকারীকে দান করতেন। (বায়হাকী)

 

আল্লাহপাক রোজা আমাদের ওপর ফরজ করেছেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ কোরআনে বলেছেন – “হে মু’মিনগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে। যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতদের উপর। যাতে করে তোমরা তাকওয়া ও পরহেজগারী অর্জন করতে পারো।” (সূরা বাক্বারা, আয়াত : ১৮৩)

 

রমজান মাস অত্যন্ত মহিমান্বিত মাস কারণ এ মাসেই পবিত্র কোরআন মাজীদ নাজিল হয়েছে। আল কোরআনের ভাষায় “রমজান মাস এমন এক মাস, এ মাসেই কোরআন নাজিল হয়েছে, যা সমগ্র মানবজাতির জন্যে দিশারী, সত্যপথের স্পষ্ট পথনির্দেশকারী এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নিরুপণকারী।” (সূরা বাক্বারা, আয়াত : ১৮৫)

সামগ্রিকভাবে, রমজান হল মুসলমানদের জন্য তাদের আধ্যাত্মিকতা বৃদ্ধির দিকে মনোনিবেশ করার, অন্যদের সাথে তাদের সম্পর্ক জোরদার করার এবং আরও ভালো মানুষ হওয়ার সময়।

রমজান মাসের করণীয়

রমজান হল আধ্যাত্মিক প্রতিফলন এবং আত্ম-শৃঙ্খলার মাস, এবং এই সময়ে মুসলিমরা সোয়াবকে সর্বাধিক করার জন্য বেশ কয়েকটি  ইবাদতে লিপ্ত থাকে।  মুসলমানরা রমজানে প্রতিদিন ভোর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজা রাখে। এর মানে হল দিনের আলোতে খাবার, পানীয়, ধূমপান এবং অন্যান্য শারীরিক চাহিদা থেকে বিরত থাকা। রমজান মাসে মুসলমানদের আরও বেশি সালাত আদায় করতে উত্সাহিত করা হয়,  রাতে এশার নামাজের  পরে তারাবিহ নামক বিশেষ  নামাজ  আদায় করা হয়। মুসলমানদেরকে রমজান মাসে আরও বেশি করে কুরআন পড়তে এবং অধ্যয়ন করতে উত্সাহিত করা হয়, অনেক মসজিদে প্রতিদিন কুরআন অধ্যয়নের সেশন দেওয়া হয়। রমজান হল অন্যদের দান এবং সাহায্য করার সময়, এবং মুসলমানদের দান করতে এবং বিশেষ করে এই সময়ে অভাবীদের সাহায্য করার জন্য উত্সাহিত করা হয়। রমজান হল মুসলমানদের জন্য তাদের আধ্যাত্মিক যাত্রার প্রতি চিন্তা করার, ক্ষমা চাওয়ার এবং অন্যদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করার সময়। ইফতার প্রায়ই পরিবার এবং বন্ধুদের সাথে ভাগ করে নেওয়া হয়।  এতে পরিবারের মাঝে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে।  রমজান মুসলমানদের একত্রিত হওয়ার, খাবার ভাগ করে নেওয়ার এবং তাদের সম্প্রদায়ের বন্ধনকে শক্তিশালী করার একটি   উত্তম সময়।

 

সামগ্রিকভাবে, রমজান মুসলমানদের জন্য তাদের বিশ্বাসকে আরও গভীর করার এবং আধ্যাত্মিকতা, সহানুভূতি এবং আত্ম-শৃঙ্খলার অনুভূতি প্রকাশ করার সময়। এই নির্দেশিকা এবং অনুশীলনগুলি অনুসরণ করে, মুসলমানরা এই পবিত্র মাসের বরকত ও সুবিধাগুলি সর্বাধিক করতে পারে।

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!