কিভাবে প্রতিদিন কিছু কাজ করে নিজের জীবনধারার উন্নয়ন সাধন করবেন।
প্রতিদিন আমাদের কি করা উচিত? এ বিষয়ে কি আমরা ভাবি? অনেকে হয়ত ভাবি? অনেকে ভাবার সময়ই পাইনা। আবার কেউ সব জানি তবু কিছু করিনা। কিন্তু ‘জ্ঞান থাকলেই যে জ্ঞানী হওয়া যায় না’। জ্ঞানের যতার্থ ব্যবহারের মাধ্যমেই জ্ঞানীর পরিচয়।
কিছু কিছু কাজ আছে যা আমাদের প্রায় বাধ্য হয়েই করতে হয়। এধরণের কাজ আমরা সকলেই বিনা দ্বিধায় করে থাকি। বিশেষ করে আমাদের পেশাগত কাজই হল সে কাজ। কিছু কিছু কাজ আমরা আনুষ্ঠানিক ভাবে মাঝে মাঝে করি, যেমনঃ সামাজিক, ধর্মীয় এবং দেশীয় বা আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠান। কিন্তু এর একটিও আমার আজকের আলোচনার উপজীব্য বিষয় নয়। এসবের বাইরেও আমাদের সকলেরই কিছু সাধারন করণিয় বিষয় রয়েছে যা প্রতিটি পেশা, শ্রেণী ও ধর্মের মানুষের কাছে সম গুরুত্বপূর্ণ।
আমাদের জীবন ধারায় কিছু দৈনন্দিন কাজের আবশ্যকতা আছে। এই কাজগুলো আমাদের দেহ ও মনে শান্তি আনে। এনে দেয় আমাদের জীবন ধারায় ছন্দ। আসুন জেনে নিই কিভাবে প্রতিদিন কিছু কাজ করে নিজের জীবনধারার উন্নয়ন সাধন করা যায়।
১) দিনে অন্তত একবার প্রকৃতির সান্নিধ্যে আসুনঃ
আপনি হয়ত ভাবছেন মানুষ কিভাবে প্রকৃতির বাইরে থাকে। প্রকৃতি মানেই আমাদের চারপাশের পরিবেশ যেখানে আমরা বাস করি। শাব্দিক অর্থে প্রকৃতি তা বুঝালেও সাহিত্য কিন্তু তা বলেনা। কোন রকম কৃত্রিমতা বর্জিত প্রাকৃতিক পরিবেশই হল প্রকৃতি। অনেক বড় বড় কবি সাহিত্যিক প্রকৃতিকে ভালবেসে সৃষ্টি করেছেন কত অনবদ্য কীর্তি। তারা সৃষ্টি করতে পেরেছেন, কারণ প্রকৃতির সান্নিধ্যে এলে প্রকৃতি আমাদের মনকে বিকশিত করতে সাহায্য করে। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ছিলেন প্রকৃতি প্রেমিক।
বিশ্বে যারা যারা মহান দৃষ্টি দিয়ে বৃহৎ সৃষ্টি করে গেছেন বা করছেন, বলতে পারবেন কে প্রকৃতি প্রেমিক ছিলেননা? নিউটন আপেল গাছতলায় বসে প্রকৃতি না দেখলে হয়ত মাধ্যাকর্ষন শক্তিতত্ত্ব আবিস্কার করতে পারতেন না। তেমনি Wordsworth, Shakespeare এর মত লেখকগণ পাহাড়, বন, নদী না দেখলে হয়ত একটি লিখাও লিখতে পারতেন না। তাই মনটাকে প্রশান্তি দিতে দেহটাকে প্রকৃতির সান্নিধ্যে আনুন, দেখবেন আপনার সুচিন্তাবৃত্তি খুলে দিবে দুয়ার। দুঃচিন্তা মানুষের হার্টের ক্ষতি করলেও সুচিন্তা মানুষের মনে প্রশান্তি আনে ও হার্টকে ঠিক রাখে।
২) শারীরিক ব্যয়াম করুনঃ
বিধাতার সৃষ্ট এই দুনিয়ায় যুগে যুগে মানুষ আসছে তাদের কিছু দায়িত্ব নিয়ে। বসে থেকে অলস জীবন ধারনের জন্য নয়। আর তা করতে গেলেও আমাদের শরীর নিজের থেকেই কাজ করা বন্ধ করতে শুরু করে দিবে। যে যন্ত্র গুলো শরীরের ভিতরে আমাদের শক্তি যোগান দেয় সেগুলো আন্দোলিত না হলে তাদের কাজ কর্মে বিরুপ প্রভাব পড়বে। তাই দেহকে সুস্থ ও সচল রাখতে কায়ীক পরিশ্রমের এবং ব্যয়ামের কোন বিকল্প নেই।
কোন ব্যক্তি নিয়মিত ব্যয়াম করলে তিনি বেশ কিছু উপকার ভোগ করেন। প্রথমত তিনি সারাদিন কাজ করার উদ্যোম পান। তার ঘুম ভালো হয়। তিনি খুব কম অসুস্থ হন। তার মাংশপেশী সুদৃঢ় হয়। তিনি মোটা হওয়া থেকে রক্ষা পান। বিশিষ্ট এনাটমিষ্টস POORTMANS ও HOWALD তাঁদের Metabolic Adaptation to Prolonged Physical Exercise: Proceedings of the … নামক বইটির ৪৭৬ পৃষ্টায় নিয়মিত ব্যয়াম আমাদের শর্করা, আমিষ ও অন্যন্য খাদ্য শক্তি বীপাকিয় পদ্ধতিতে কিভাবে সাহায্য করে তা বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রামান করেছেন। শুধু Metabolic System নয় এ ভালো অভ্যেস টি আমাদের শ্বাসপ্রশ্বাস, রেচন তন্ত্র, হার্টকেও সুস্থ রাখে।
অনেক গবেষণায় দেখা গেছে যে যারা শারীরিক ব্যয়াম করে তারা মানসিক দিক থেকেও সুস্থ থাকেন। তাদের জীবন ধারায় নিয়মানুবর্তিতার ছোঁয়া থাকে।
৩) বন্ধুবান্ধব ও পরিবার পরিজনের সাথে মিশুনঃ
কয়েক বছর আগে প্রথম আলো পত্রিকায় দেখেছিলাম, কোন এক বিদেশী চিকিৎসা বিষয়ক ম্যাগাজিনের বরাত দিয়ে একটি বার্তা প্রকাশ করা হয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছিল যে দিনে অন্তত পাঁচজন ব্যক্তির একটি দলের সাথে আড্ডা দিন। সেখানে আয়ু বাড়ার কথাও বলা হয়েছিল। তবে আয়ু বাড়ুক বা না বাড়ুক নিয়মিত পাঁচজন ব্যক্তির একটি দলের সাথে আড্ডা দিলে মনের রোগ যে নিরাময় হয় এর ঢের প্রমান আছে। তাই মনকে সুস্থ রাখুন আপনার পরিবার এবং আপনার বন্ধু বান্ধবের সাথে মিশুন।
বন্ধু শব্দটি কিন্তু ব্যাপক। তারা আপনার চেয়ে বড় হোক বা ছোট, যদি তাদের সাথে মিশে আপনার মানষিক বা শারীরিক অবক্ষয় না হয়, আপনার মনের আনন্দ বেদনা ভাগাভাগি করা যায় এবং আপনার বিপদে তারা এবং তাদের বিপদে আপনার মনে কোন দায়িত্ববোধ জাগ্রত হলে বুঝবেন তারা আপনার প্রকৃত বন্ধু।
তবে আপনার বন্ধু নির্বাচনে সাবধান হওয়া ভালো। আপনার বন্ধুরা যদি নিয়মানুবর্তি ও রুচিশীল হয় তাহলে আপনিও তার কিছুটা হলেও তাই হবেন। প্রয়াত আমেরিকান লেখক এবং বক্তা জিম রন একটা কথা বলেছিলেন, “ আপনি সেই পাঁচজন মানুষের গড় যে পাঁচ জন মানুষের সাথে আপনি সবচেয়ে বেশি সময় কাটান।” তাই আপনার বন্ধুরা যদি ভাল ও বুদ্ধিমান হয় তবে আপনিও তাদের গড়।
তাই ভালো বন্ধুর সাথে মিশে নিজের বুদ্ধিমত্তা ও জীবনধারার পরিবর্ত ঘটান।
৪) নিজের ধর্মীয় অনুশাসন মানুন ও প্রার্থনা করুনঃ
মানুষকে বিধাতা সৃষ্টি করেছেন ও ভালো মন্দ জ্ঞান দান করেছেন। প্রতিটি ধর্মেই নৈতিক শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। তাই ধর্ম যদি কল্যাণের কথা বলে, তবে তা মানতে ক্ষতি কোথায়। তাছাড়া ধর্মীয় অনুশাসন মানলে দু ধরনের উপকার হবে।
১। নিজের আত্মাকে পবিত্র মনে হবে তাতে করে খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকার স্পৃহা বাড়বে।
২। সমাজে শান্তি-শৃংখলা ফিরে আসবে।
তাই আমাদের নিজ নিজ ধর্মের অনুশাসন মেনে চলা উচিত।
৫) মন খুলে হাসুনঃ
আমি কয়েকজন মনরোগ বিষেশজ্ঞ ও কার্ডিওলজিস্ট ( হৃদরোগ বিষেশজ্ঞ) এর পরামর্শ এবং কিছু চিকিৎসা বিষয়ক ম্যাগাজিনের আলোকে বলতে পারি মন খুলে হাসলে মানুষের দুরারগ্য রোগ আরগ্য লাভের রাস্তা খুলে যায়। ভারতের বাঙ্গালরে তাই ক্যান্সার রোগীদের বিনোদনের ব্যবস্থা করছেন। মানষিক উদ্বিগ্নতা অনেক রোগ এমন কি মৃত্যুও ডেকে আনে। মন খুলে হাসতে পারলে উদ্বিগ্নতা কমে। প্রতিদিন মন খুলে হাসুন সুস্থ থাকুন ।
৬) মেডিটাশন বা ধ্যাণ করুনঃ
ধ্যান বা মেডিটেসন আমাদের জীবনধারার উন্নয়নে ব্যাপক ভুমিকা পালন করে। আমাদের বিক্ষিপ্ত মনকে কেন্দ্রিভুত করন। ব্রেইন প্রশিক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ, অস্থিরতা দূরীকরণ, প্রশান্তি আনয়ন, মনো্যোগীতার মাত্রা বৃদ্ধি ও আমাদেরন পঞ্চইন্দ্রিয়ের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার সাথে সাথে ষষ্ঠ ইন্দ্রের উন্নয়ন সাধনে ধ্যান বা মেডিটেসনের কোন বিকল্প নেই।
৭) ২৪ ঘন্টার মধ্যে অন্তত ৬ থেকে ৭ ঘন্টা ঘুমানঃ
ঘুম এবং বিশ্রাম আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর আমাদের মস্তিষ্ক, শরীরের মধ্যে আমরা একটি নির্দিষ্ট সময় কাজ করার ক্ষমতা অর্জন করি। একটি রাতের ঘুম তার পূর্ববর্তী দিনের অবশাদ ও ক্লান্তি দূর করে আর পরবর্তী দিনের কাজের জন্য আমাদের প্রস্তুত করে। তাই প্রতিদিন অন্তত ৬ থেকে ৭ ঘন্টা ঘুমান উচিত। প্রতিদিন একই সময় ঘুমালে এর ফলাফল অত্যন্ত লাভ জনক।
৮) আশাবাদী থাকুনঃ
লিও তলস্তয় বলেছেন, “মানুষ বাঁচে আশায়”। প্রেম ভালবাসা ও কোন লক্ষ্যকে সামনে রেখে এগিয়ে গেলে তা না পাওয়া গেলেও তার কাছাকাছি যাওয়া যায়। তাই লক্ষ্য পূরণ না হলে আশা হত হবেন না। আশা হারালে বাঁচা যাবে না। পবিত্র কুরআন এ ঈমানদারদের আশা হত হতে নিষেধ করা হয়েছে। মুহাম্মদ (সঃ) বলেছেন, “নিশ্চয় প্রত্যেকটি আমল তার নিয়তের উপর নির্ভরশীল”। শ্রী কৃষ্ণ মহাভারতে অর্জুনকে আশাহত হতে নিষেধ করেছেন। তবে আপনি কেন আশাহত হবেন। আসুন আমরা বিখ্যাত লেখক পি বি শেলির সাথে ঠোট মিলিয়ে বলি, ” If winter comes, can spring be far behind“.
৯) দিনে অন্তত একটি ভাল কাজ করুনঃ
আপনার করা যেকোন ভাল কাজই আপনাকে শান্তি দিবে। দিনে একটি হলেও ভাল কাজ করুন ও শান্তিতে থাকুন। রাস্তা থেকে কোন তারকাঁটাও যদি সরিয়ে ফেলা হয়, এটিও একটি ভালো কাজ। তাই ছোটই হোক, কিংবা বড় অন্তত দিনে একটি ভালো কাজ করুন। এই অদ্ভুত ছোট কাজ করলেই দেখবেন আপনার মানবিক গুনাবলীর উন্নয়ণ ঘটবে।
১০) যেকোন একটি খারাপ অভ্যেস খুজে বের করুন ও ত্যাগ করুনঃ
সেই ব্যক্তি সর্বাপেক্ষা বুদ্ধিমান যে নিজের আত্ম-সমালোচনা করতে পারে। কথাটি আমরা অনেকেই জানি। কিন্তু আমার মতে সেই ব্যক্তি এর চেয়েও বেশী বুদ্ধিমান ও উন্নত যে তার আত্ম-সমালোচনার মাধ্যমে পাওয়া ভুল-ত্রুটি গুলো সংশোধন করতে পারে। আমরা যদি প্রতিদিন আমাদের একটি ভুল ধরে তা ত্যাগ করার চেষ্টা করি, তাহলে পৃথিবীর চেহারা পালটে আরও সুন্দর রুপ লাভ করবে।
১১) আপনার আপনজনকে স্পর্শ করুন
আপনার আপনজন যারা তাদের সান্নিধ্যে থাকার চেষ্টা করুন। তাদের ভালবাসুন, কাছে টেনে নিন। ছোটদের স্নেহ করুন, বড়দের সম্মান করুন পারলে হান্ডসেক করুন, কোলাকুলি করুন। দেখবেন হৃদয়ের শুণ্যতা কেটে যাবে। এটিও প্রতিদিন কিছু কাজ করে নিজের জীবনধারার উন্নয়ন সাধন করার অন্যতম একটি কাজ।
১২) নিজেকে একটি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিনঃ
লক্ষ্যহীন মানুষের জীবন মাঝিহীন নৌকার মতই। নিজেকে গড্ডালিকা প্রবাহের মত ছেড়ে না দিয়ে কোন লক্ষ স্থির করে সামনে এগিয়ে চলেন। নিজেকে ছোট ছোট চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিন এবং সে অনুযায়ী প্রতিদিন কিছু কাজ করে নিজের জীবনধারার উন্নয়ন সাধন করার পথে এগিয়ে চলুন।
১৩) যে কাজ আপনাকে নতুন কিছু শেখায় :
আত্ম উন্নয়ন প্রতিটি মানুষের ই কাম্য । প্রতিদিন এমন কিছু করুন যা আপনাকে নতুন কিছু শেখায় । ভাবছেন, আমার তো পড়াশুনা শেষ ! এখন আবার কি শিখবো ! আসলে শেখার শেষ নেই । খুজে দেখুন আপনার আশেপাশের অনেক কিছুর ব্যবহার ই আপনার অজানা । সবচেয়ে ভালো হয় এমন কোন কর্মক্ষেত্র খুজে নেয়া যা আপনার আত্ম উন্নয়নে সহায়তা করে । কারন আত্ম উন্নয়নই আপনার প্রমশনের প্রধান চাবি কাঠি 🙂
আমার একজন খুব প্রিয় শিক্ষক আমাকে প্রায়ই বলতেন, পেশাগত/শিক্ষাগত জীবনে সবসময় বিকল্প বিষয় চিন্তা করে রাখতে । তার মতে কম পক্ষে তিনটি দিক ঠিক করে রাখা উত্তম । আসলে মানুষের সব আশা পুরোন হয়না, ধরুন আপনার জীবনের একমাত্র লক্ষ হল আপনি ডাক্তার হবেন । কিন্তু দেখা গেলো কোন দূর্ঘটনায় আপনার সে আশা পুরোন হলো না ! এই অবস্থায় অনেকেই ভেঙ্গে পড়েন ! কিন্তু যদি বিকল্প বিষয় চিন্তা করা থাকে তাহলে আপনি আশা হত না হয়ে অন্য পথটি ধরে এগিয়ে যাবেন ।
আসুন আমরা সকলে এক হয়ে আগামীর পৃথিবী গড়ি। উপরে দেখান কিছু কাজ করলে আমরা পৃথিবীর মঙ্গল সাধনের পথযাত্রীর একজন হতে পারব। এভাবেই আমাদের দৃষ্টি ভঙ্গির পরিবর্তনের সাথে সাথে পুরো পৃথিবী বদলে যাবে।