কিভাবে ঋণ জামানতে চার্জ আরোপ করা হয়: চার্জের প্রকারভেদ ও আরোপ পদ্ধতি
জামানতে চার্জ আরোপ বলতে ঐ জামানতের উপর ব্যাংকের আইনি অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বোঝানো হয়। গ্রাহকের প্রস্তাবিত সম্পত্তিতে আইনি অধিকার প্রতিষ্ঠা না হলে প্রদত্ত ঋণ নিরাপদ হয় না। তাই ঋণের জামানতের পাশাপাশি কীভাবে ঋণ জামানতে চার্জ আরোপ করা হয় তা জানাও গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে ব্যাংকের একজন ক্রেডিট অফিসারকে ঋণ জামানতে চার্জ আরোপ করার বিষয় সম্পর্কে ভাল জ্ঞান রাখতে হবে।
ঋণ জামানতে চার্জ আরোপ
এখানে এ কথা মনে রাখতে হবে যে, জামানতের উপর চার্জ সৃষ্টি হলে তা সাধারণত উক্ত সম্পত্তির উপর ব্যাংকের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে, তবে তাতে কোন ধরণের মালিকানা পরিবর্তন হয় না। আর তাই কীভাবে ঋণ জামানতে চার্জ আরোপ করতে হবে তা ভালভাবে জানতে হবে।
আমরা ঋণ জামানতে চার্জ আরোপ কে দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করে আলোচনা করছি
- চার্জের প্রকারভেদ
- চার্জ আরোপ পদ্ধতি
চার্জের প্রকারভেদ – কত প্রকার চার্জ আরোপ করা যায়
- ফিক্সড চার্জ
- ফ্লোটিং চার্জ
- প্যারি-পাসু চার্জ
- সেকেন্ড চার্জ
- ফার্দার চার্জ
চার্জ আরোপের ধাপ গুলো একে একে আলোচনা করা যাক
ক. ফিক্সড চার্জ:
কোন স্থায়ী ধরণের সম্পদের উপর ব্যাংকের অধিকার প্রতিষ্ঠা করলে তা ফিক্সড চার্জ বলে অভিহিত হয়।
এ ধরণের চার্জকে সাধারণভাবে বন্ধক বলা হয়।
স্বাভাবিকভাবে এই ধরনের জামানত গ্রহীতার দখলে থাকলেও তা ঋণপ্রদানকারীর অধীনে থাকে।
ঋণগ্রহীতা এ সম্পত্তি ততক্ষণ অন্য কোন স্থানে বিক্রয় বা হস্তগত করতে পারেন না যতক্ষণ না তার ঋণ পরিশোধিত হয়।
আবার ঋণপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠানও এর মালিকানা পেয়ে যাবে ব্যাপারটা এরকম নয়।
তবে যদি ঋণগ্রহীতা কোন কারণে ঋণ পরিশোধে ব্যার্থ হয় তাহলে তার বন্ধকীকৃত সম্পত্তি ঋণপ্রদানকারী সংস্থা ক্ষতিপূরণে দখলে নিতে পারে বা বিক্রয় করতে পারে।
তবে তার জন্য আইনি অনুমোদন নিতে হবে এবং সমস্ত পাওনা ছেড়ে দিতে হবে।
খ. ফ্লোটিং চার্জ:
সর্বদা পরিবর্তিত হয় এমন সম্পদের উপর যে ধরণের চার্জ প্রতিষ্ঠা হয় তাই ফ্লোটিং চার্জ।
এটি গতিশীল প্রকৃতির কারণ এতে সম্পত্তির মান ও পরিমাণ উভয়ই পরিবর্তিত হয়।
ঋণের পুনঃতফসিল সুরক্ষিত করণে ব্যবহার করা হয়।
এ ধরণের জামানতে ঋণগ্রহীতা তার সম্পদ ব্যবহার ও হস্তান্তরকরতে পারে।
তার জন্য কোন ধরণের পূর্ব অনুমোদন প্রয়োজন হয় না।
তবে ফ্লোটিং চার্জও ফিক্সড চার্জে রূপান্তরিত হতে পারে। তবে তা তখনি হবে যখন
১. গ্রহীতা সংস্থা প্রায় শেষ হতে যাচ্ছে
২. সংস্থাটির ভবিষ্যত অস্তিত্ব বন্ধ হলে
৩. আদালতের সিদ্ধান্ত হলে
৪. ঋণখেলাপী হলে এবং তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হলে।
গ. প্যারি-পাসু চার্জ:
প্যারি-পাসু (Pari-Passu) একটি ল্যাটিন শব্দ যার অর্থ দাড়ায় সমান্তরাল ভাবে অগ্রসর হওয়া।
একাধিক ব্যাংক যখন একটি সম্পদের উপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করে তখন তাকে প্যারি-পাসু চার্জ বলা হয়।
বিশেষ করে কনসোর্টিয়াম লোন বা সিন্ডিকেট লোনের সময় এটির ব্যবহার হয়।
দুই বা ততোধিক ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে একটি প্রতিষ্ঠান কে ঋণ প্রদান করে।
এবং জামানত হিসেবে একটি সম্পদকে সকলেই গ্রহণ করে।
এ সকল ক্ষেত্রে প্রত্যেক বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগ অনুপাত অনুসারে অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়।
একটি উদাহরণ দিয়ে বুঝানো যাক।
ধরি এ বি ও সি তিনজন মিলে এক্স প্রতিষ্ঠানকে ৫০ কোটি ঋণ প্রদান করল।
যাদের বিনিয়োগ অনুপাত এ= ২০ কোটি, বি=১৫ কোটি, সি=১৫ কোটি টাকা।
ঋণ খেলাপি হবার কারণে গ্রহীতার সম্পত্তি ৪০কোটি টাকায় বিক্রয় হল।
তাহলে এ পাবে ১৬ কোটি, বি পাবে ১২ কোটি, সি পাবে ১২ কোটি।
এরূপ চার্জ এর সৃষ্টি হওয়াকেই প্যারি পাসু চার্জ বলা হয়।
ঘ. সেকেন্ড চার্জ:
যখন একই জামানত কে অবলম্বন করে দুটি ভিন্ন ব্যাংক একই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে দুটি ভিন্ন প্রকল্পে বা ভিন্ন কাজে ঋণ প্রদান করে তখন দ্বিতীয় ব্যাংকের চার্জকেই সেকেন্ড চার্জ বলা হয়।
প্যারি পাসু চার্জএর সাথে এর পার্থক্য কেবল এক জায়গাতেই।
তা হলো প্যারি পাসু চার্জ প্রতিষ্ঠিত হয় একই খাতে বা একই প্রকল্পে। অন্যদিকে সেকেন্ড চার্জ প্রতিষ্ঠিত হয় দুটি ভিন্ন খাতে বা ভিন্ন প্রকল্পে।
ঙ. ফার্দার চার্জ:
কোন ব্যাক্তি বন্ধকী সম্পত্তির উপর ভিত্তি করে ঋণ থাকা অবস্থায় একই ব্যাংক থেকে পুনরায় বিনিয়োগ সুবিধা গ্রহণ করলে উক্ত জামানতে যে চার্জ প্রযোজ্য হয় তাই ফার্দার চার্জ নামে পরিচিত।
চার্জ আরোপ পদ্ধতি – ঋণ জামানতে চার্জ আরোপে বিভিন্ন পদ্ধতি
এবার আলোচনা করা যাক ঋণ জামানতে চার্জ আরোপে বিভিন্ন পদ্ধতি।
ঋণ জামানতে চার্জ আরোপের জন্য বিভিন্ন প্রকার পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। নিচে এদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দেয়া হল:
১. প্লেজ:
কারো কাছে অস্থাবর সম্পদের বন্ধকীকরণকে প্লেজ বলা হয়।
প্লেজের মালামাল বিক্রয় করতে কোর্টের অনুমতি প্রয়োজন হয়না। এটি ব্যাংকের দখলে থাকলেও তার মালিক ব্যাংক নয়।
২. হাইপোথিকেশন:
বিনিয়োগ সিকিউরিটি হিসেবে অস্থাবর সম্পত্তি নিজের দখলে রেখে তার উপর ব্যাংকের অধিকার প্রদান কেই বলা হয় হাইপোথিকেশন।
এটি দখলবিহীন জামানত যা বিনা দখলে অধিকার নিশ্চিত করে।
আদালতের অনুমতি ছাড়া ব্যাংক হাইপোথিকেশন করা মালামাল বিক্রয় করতে পারে না।
৩. মর্টগেজ:
বিনিয়োগের সিকিউরিটি হিসেবে কোন স্থাবর সম্পদের অধিকার ব্যাংকের কাছে হস্তান্তর করাকে মর্টগেজ বলা হয়।
দখল মূল মালিকের কাছে থাকে।
৪. লিয়েন:
ঋণ গ্রহীতার ঋণ পরিশোধের পূর্ব পর্যন্ত পাওনাদার যদি কোন সম্পত্তি আটক রাখার অধিকারকেই বলা হয় পূর্বস্বত্ত্ব বা লিয়েন।
৫. এসাইনমেন্ট:
বিনিয়োগের সিকিউরিটি হিসাবে গ্রাহক যখন তার সঞ্চয়ী ও ভবিষ্যত ব্যালেন্সকে উত্তোলনের অধিকার ব্যাংক কে প্রদান করে তখন তাকে এসাইনমেন্ট বলা হয়।
এসাইনমেন্ট এ তিনটি পার্টি থাকে। আর তাই একে দুর্বল ও ঝুকিপূর্ণ সিকিউরিটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
৬. সেট-অফ:
এটি ব্যাংকারের আইনগত অধিকার। গ্রাহকের সঞ্চয়ী হিসাবের ব্যালেন্স দিয়ে তার পাওনা হিসাব সমন্বয় করতে পারে ব্যাংক। তবে এটি প্রয়োগের ক্ষেত্রে ঋণের অংক সুনির্দিষ্ট হতে হয়।
৭. গ্যারান্টি:
সহজ ভাষায় ঋণ গ্রহীতার দেনা পরিশোধের অঙ্গীকার যখন তৃতীয় কোন ব্যাক্তি করে থাকে তখন তাকে গ্যারান্টি বলা হয়।
ঋণের জামানতে মূলত এটির ব্যবহার প্রচুর।
একে ব্যাক্তিগত জামানত নামে অভিহিত করা হয়।
তবে এর আরও একটি প্রকার রয়েছে যার নাম ব্যাংক গ্যারান্টি।
কোন ব্যাংক যখন কোন গ্রাহকের দেনা পরিশোধের অক্ষমতায় দেনা পরিশোধের অঙ্গীকার করে তখন তাকে ব্যাংক গ্যারান্টি বলা হয়।
৮. ইনডেমনিটি:
এটি এক প্রকার চুক্তি যার একপক্ষ অন্যপক্ষকে দায়মুক্তি বা যে কোন ক্ষতির হাত থেকে রক্ষার অঙ্গীকার করে থাকে।
মূলত ক্ষতিপূরণের জন্যই ইনডেমনিটি করা হয়।