রক্ত কি? এর গঠন উপাদান ও কাজ কী? মানবদেহে রক্তের গুরুত্ব সর্ম্পকে বিস্তারিত জানতে চাই।
রক্ত কি:
রক্ত হচ্ছে একধরনের তরল যোজক কলা, যার মাধ্যমে বিভিন্ন রক্তবাহিকা দেহের সকল কোষে পুষ্টি, ইলেক্ট্রোলাইট, হরমোন, ভিটামিন, অ্যান্টিবডি,অক্সিজেন, ইমিউন কোষ ইত্যাদি বহন করে এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও বর্জ্য পদার্থ বের করার জন্য বহন করে।
একজন পূর্ন বয়স্ক মানুষের শরীরে ৫-৬ লিটার রক্ত থাকে। রক্ত সামান্য ক্ষারীয়। রক্তের pH মাত্রা ৭.৩৫-৭.৪৫। এর তাপমাত্রা ৩৬-৩৮° সেলসিয়াস। অজৈব লবণের উপস্থিতির জন্য রক্তের স্বাদ নোনতা।
রক্তের গঠন উপাদান ও কাজ
রক্তের দুটি অংশঃ রক্তরস বা প্লাজমা ও রক্তকণিকা রক্তকোষ । মানবদেহের রক্ত শতকরা ৫৫ ভাগ রক্ত রস অর্থাৎ প্লাজমা এবং শতকরা ৪৫ ভাগ রক্তকণিকা নিয়ে গঠিত।
রক্তরস বা প্লাজমা:
রক্তের হালকা হলুদ বর্ণের তরল অংশকে রক্তরস(Plasma) বলা হয়। রক্তরস তরল কঠিন পদার্থের সমন্বয়ে তৈরি। এতে তরল পদার্থের(পানির) পরিমাণ ৯০-৯২% এবং কঠিন পদার্থের পরিমাণ ৮-১০%।
রক্তরসের কাজ:
১. রক্তের তরলতা রক্ষা করে এবং ভাসমান রক্ত কণিকাসহ অন্যান্য দ্রবীভূত হয়ে পদার্থ দেহের সর্বত্র পরিবাহিত হয়।
২. পরিপাকের পর খাদ্যসার রক্তরসে দ্রবীভুত হয়ে দেহের বিভিন্ন টিস্যু ও অঙ্গে বাহিত হয়।
৩. টিস্যু থেকে যে সব বর্জ্যপদার্থ বের হয় তা রেচনের জন্য বৃক্কে নিয়ে যায়।
৪. টিস্যুর অধিকাংশ কার্বন ডাই অক্সাইড রক্তরসে বাইকার্বনেটরুপে দ্রবীভূত থাকে।
৫. রক্তর জমাট বাঁধার প্রয়োজনীয় উপাদান গুলো পরিবহন করে।
রক্তের কণিকা বা রক্তকোষগুলোকে তিন শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। যথাঃ
- লোহিত রক্তকণিকা – ইরাথ্রোসাইট
- শ্বেত রক্তকণিকা – লিউকোসাইট
- অণুচক্রিকা – থ্রম্বোসাইট
১. লোহিত রক্তকণিকা বা ইরাথ্রোসাইট
মানবদেহের রক্তরসে ভাসমান গোল, দ্বি-অবতল চাকতির মতো, নিউক্লিয়াসবিহীন কিন্তু অক্সিজেনবাহী হিমোগ্লোবিনযুক্ত, লাল বর্ণের কণিকাকে লোহিত রক্তকণিকা বলা হয়। এ ধরনের কণিকার গড় ব্যাস ৭.৩মিউম ও গড় স্থুলতা ২.২মিউম এবং এটির কিনারা অপেক্ষা মধ্যভাগ অনেক পাতলা।
লোহিত রক্তকণিকার কাজঃ
ক. হিমোগ্লোবিনের মাধ্যমে ফুসফুস থেকে দেহকোষে অধিকাংশ অক্সিজেন ও সামান্য পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড সরবরাহ করে।
খ. রক্তের ঘনত্ব ও আঠালো ভাব রক্ষা করে।
গ. হিমোগ্লোবিন বাফার হিসেবে রক্তে অম্ল-ক্ষারের সমতা রক্ষা করে এবং রক্তের সাধারণ ক্রিয়া বজায় রাখতে সাহায্য করে।
ঘ. রক্তের আয়নিক ভারসাম্য অব্যাহত রাখে।
ঙ. এসব কণিকা রক্তে বিলিভার্ডিন ও বিলিরুবিন উৎপন্ন করে।
২. শ্বেত রক্তকণিকা বা লিউকোসাইট
রক্তে অবস্থিত নিউক্লিয়াস যুক্ত, বর্ণহীন অনিয়তাকার রক্তকণিকা দের শ্বেত রক্তকণিকা বা লিউকোসাইট বলে। শ্বেত রক্তকণিকার নির্দিষ্ট আকার নেই। প্রতি মিলিমিটার রক্তে শ্বেত কণিকার সংখ্যা হল ৫০০০-৯০০০।
প্রতিটি শ্বেত কণিকা লাইকো-প্রোটিন নির্মিত কোষঝিল্লি পরিবেষ্টিত থাকে। সাইটোপ্লাজমের মধ্যে নিউক্লিয়াস উপস্থিত থাকে। নিউক্লিয়াস গোলাকার আকৃতির এবং কয়েকটি খন্ড বিশিষ্ট হয়। সাইটোপ্লাজম দানাযুক্ত বা দানাবিহীন আঙ্গানু থাকে।
সাইটোপ্লাজমের দানার উপস্থিতির উপর নির্ভর করে শ্বেত রক্তকণিকাদের দুই ভাগে ভাগ করা হয় যথা-
গ্রানুলোসাইট বা দানাযুক্ত শ্বেত রক্তকণিকা এবং অ্যাগ্রানুলোসাইট বা দানাবিহীন শ্বেত রক্তকণিকা।
গ্রানুলোসাইট শ্বেতকণিকা তিন রকমের নিউট্রোফিল, ইউসিনোফিল, বেসোফিল। অ্যাগ্রানুলোসাইট শ্বেত রক্তকণিকা দুই রকমের যথা- মনোসাইট, লিম্ফোসাইট।
দেহকে জীবাণুঘটিত রোগ থেকে মুক্ত রাখতে যে রক্তকণিকা ইমিউন তন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে সদা তৎপর থাকে তা হাচ্ছে শ্বেত রক্তকণিকা। যেভাবে ও যে পথে জীবাণুর অনুপ্রবেশ ঘটুক না কেন শ্বেত রক্তকণিকার দুটি বিশেষ প্রহরী B-লিস্ফোসাইট ও ফ্যাগোসাইট অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সেগুলোর মোকাবিলা করে মানুষের জীবন রক্ষা করে।
শ্বেতরক্তকণিকার কাজঃ
ক. মনোসাইট ও নিউট্রোফিল ফ্যাগোসাইটোসিস প্রক্রিয়ায় জীবাণু ভক্ষণ করে ধ্বংস করে।
খ. লিস্ফোসাইটগুলো অ্যান্টিবডি সৃষ্টি করে রোগ প্রতিরোধ করে।
গ.বেসোফিল হেপারিন সৃষ্টি করে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
ঘ. দানাদার লিউকোসাইট হিস্টামিন সৃষ্টি করে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
ঙ. ইওসিনোফিল রকাতে প্রবেশকৃত কৃমির লার্ভা এবং অ্যালার্জিক-অ্যান্টি ধ্বংস করে।
৩. অণুচক্রিকা বা থ্রম্বোসাইট
রক্তকণিকাগুলোর মধ্যে অনিয়তাকার, ঝিল্লি-আবৃত, সামান্য সাইটোপ্লাজমযুক্ত কিন্তু নিউক্লিয়াসবিহীন, কোষ-ভগ্নাংশকে অনুচক্রিকা বলে। প্রতি মিলি রক্তে প্রায় ১,৫০০০০-৩,০০০০০ অনুচক্রিকা থাকতে পারে।
এগুলোর আয়ুষ্কাল ৮-১২দিন। এগুলোর ধ্বংস প্রাপ্তি ঘটে যকৃত ও প্লীহার ম্যাক্রোফেজের মাধ্যমে। দেহের লাল অস্থিমজ্জা মেগাক্যারিওসাইট নামে বড় কোষ থেকে উৎপন্ন হয়ে রক্তরসে চলে আসে।
অনুচক্রিকার কাজঃ
ক. অস্থায়ী Platelet plug সৃষ্টির মাধ্যমে রক্তপাত বন্ধ করে।
খ. রক্তজমাট ত্বরান্বিত করতে বিভিন্ন ক্লটিং ফ্যাক্টর ক্ষরণ করে।
গ. ফ্যাগোসাইটোসিস প্রক্রিয়ায় ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস ধ্বংস করে।
ঘ. দেহের কোথাও ব্যথার সৃষ্টি হলে নিউট্রোফিল ও মনোসাইটকে আকুষ্চকরতে রাসায়নিক পদার্থ ক্ষরণ করে।
ঙ. রক্তবাহিকার এন্ডোথেলিয়ামের অন্তঃপ্রাচীর সুরক্ষার জন্য গ্রোথ-ফ্যাক্টর ক্ষরণ করে।
চ. স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি অণুচক্রিকা থাকলে রক্তনালির ভিতরে অদরকারী রক্তজমাট সৃষ্টি, স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেয়।